রবিবার, ০৩ অগাস্ট ২০২৫, ০৪:৪৪ পূর্বাহ্ন
নিজস্ব প্রতিবেদক, একুশের কন্ঠ : কাকরাইলের বাসিন্দা নিজাম উদ্দিন গোপালগঞ্জ থেকে বাসে রওনা দিয়ে বেলা ১১টায় রাজধানীর শ্যামপুরে পৌঁছান। কিন্তু শ্যামপুর থেকে বাস আর এগোতে চায় না। হানিফ ফ্লাইওভারের গোড়ায় পৌঁছতে ঘণ্টাখানেক সময় লাগে তাঁর। সেখান থেকে একটি সিএনজিচালিত অটোরিকশা নিয়ে গুলিস্তান হয়ে বাসায় পৌঁছানোর চিন্তা করেন। শুরুতে দ্রুতগতিতে অটোরিকশাটি এগোলেও কিছু সময় পরই গতি ধীর হয়ে যায়। তিনি ভাবতে থাকেন, এই বুঝি সামনের গাড়ির জট ছাড়বে। দ্রুত গাড়ি চলা শুরু করবে। এ ভাবনাতেই তাঁর কেটে যায় দীর্ঘ সময়। ফ্লাইওভারের ওপরেও যানজট, নিচেও ভরপুর গাড়িতে।
শেষ পর্যন্ত ফ্লাইওভার থেকে যখন গুলিস্তান পয়েন্টে নামেন, তখন আরও এক ঘণ্টা কেটে গেছে। নামার পরও তাঁর গাড়ি আর এগোতে চায় না। তখন অবস্থা আরও নাজুক। সার্জেন্ট আহাদ বক্স, গুলিস্তান, জিপিও ও পল্টন হয়ে বাসায় পৌঁছাতে সময় লাগে তিন ঘণ্টারও বেশি। অথচ কাকরাইল থেকে শ্যামপুরের দূরত্ব ১৩ কিলোমিটারের কাছাকাছি।
এ চিত্র গত রোববারের, তবে শুধুই সে দিনের নয়। প্রায় প্রতিদিন একই চিত্র চোখে পড়ে। রাজধানীর দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চল থেকে যেসব যানবাহন যাত্রাবাড়ী হয়ে রাজধানীতে ঢুকছে, সেগুলোর এই কয়েক কিলোমিটার পথ পাড়ি দিতেই ঘণ্টার পর ঘণ্টা পার হয়ে যাচ্ছে। ফ্লাইওভারের নিচে যেমন লেগে থাকছে যানজট, ওপরের চিত্রও ভিন্ন কিছু নয়। প্রশ্ন উঠেছে, এত বিপুল অর্থ ব্যয় করে ফ্লাইওভার তৈরি করে কী লাভ হলো?
নগর গণপরিবহন বিশেষজ্ঞ ড. সালেহ উদ্দিন বলেন, ফ্লাইওভার করার সময় পরবর্তী ১০০ বছরের চিন্তা করতে হয়। যাত্রাবাড়ী ফ্লাইওভারে এই দূরদর্শিতার ঘাটতি ছিল। পদ্মা সেতু চালু হওয়ার পর হানিফ ফ্লাইওভারের ওপর চাপ তৈরি হবে। সেই চাপ কীভাবে সামাল দেওয়া যায়, এ বিষয়েও ভাবা হয়নি। ফ্লাইওভারের নিচের রাস্তাগুলোও সার্ভিস দিতে পারছে না। এখন নিচের রাস্তাগুলো আরও প্রশস্ত করা দরকার। অথচ নিচের রাস্তা-ফুটপাতে হকার, দোকানপাট, ঘোড়ার আস্তাবল প্রভৃতি রয়েছে। দিন দিন এই অবস্থার আরও অবনতি হবে। কারণ ইচ্ছাকৃতভাবে আমরা এগুলোর প্রতি নজর দিচ্ছি না। যেদিকে চোখ যায়, শুধু মানুষ আর দোকান।
এ প্রসঙ্গে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের প্রধান প্রকৌশলী আশিকুর রহমান বলেন, যাত্রাবাড়ীর নিচের রাস্তার গাড়ি চলাচল স্বাভাবিক করতে ফ্লাইওভার আটটি অংশে ভাগ করা হয়েছে। পাঁচটার নকশা চূড়ান্ত করার পর্যায়ে আছে। বাকি তিনটির কাজ চলছে। এই কাজগুলো শেষ হলে নিচের রাস্তায় চলাচল স্বাভাবিক হয়ে যাবে।
সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে ও সরেজমিন পরিদর্শন করে জানা যায়, যাত্রাবাড়ীর পূর্বে শনির আখড়া, দক্ষিণে শ্যামপুর ও উত্তরে ডেমরা রোড থেকে ঢাকা শহরে ঢুকতে যানবাহনগুলোর যুদ্ধাবস্থা শুরু হয়। এই পুরো এলাকার সড়কগুলোতেই দোকানপাট, স্থাপনা ও হকারদের দৌরাত্ম্য। আশপাশের সড়কে ঢোকার পয়েন্টে রিকশা-ঠেলাগাড়ি দাঁড়িয়ে থাকে। পাশাপাশি সায়েদাবাদ বাস টার্মিনালের বাসগুলো গন্তব্যে ছাড়ার সময় রাস্তার ভেতরে দাঁড় করিয়ে যাত্রী নেওয়ার জন্য হাঁকডাক শুরু করে হেল্পাররা। দয়াগঞ্জ পয়েন্টে কখনও কখনও রাস্তা ফাঁকা থাকলেও ওই বাসগুলোর কারণে অন্য যানবাহনগুলোকে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়।
অন্যদিকে যেসব যানবাহন ফ্লাইওভার ব্যবহারে করে শহরে প্রবেশ করে তাদের শুরুতেই শ্যামপুরে জটে পড়তে হয়। জট কাটিয়ে ফ্লাইওভারে উঠলেও টিকাটুলীর রাজধানী মার্কেটের কাছে পৌঁছলেই গতি হারিয়ে যায়। গুলিস্তান ও চানখাঁরপুলগামী যানবাহনের ওই অংশটুকুই পার হতে ঘণ্টাখানেক ব্যয় হয়। আবার কমলাপুর অভিমুখী যানবাহনগুলোকে গোলাপবাগ পয়েন্টে নামার পরই যানজটে আটকে পড়তে হয়। আর গুলিস্তানমুখী গাড়িগুলো নামার পর আর এগোতে চায় না। কারণ সার্জেন্ট আহাদ বক্স থেকে শুরু করে জিপিও পর্যন্ত পুরো রাস্তায় হকারের দৌরাত্ম্য।
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ হকার্স লীগের সভাপতি এম এ কাশেম বলেন, সার্জেন্ট আহাদ পুলিশ বক্সটি সেখানে বসানো হয়েছিল ওই এলাকার যানবাহন চলাচলে শৃঙ্খলা ফেরানোর জন্য।
পাশাপাশি ওই এলাকার রাস্তা যেন হকারমুক্ত থাকে। তবে পুলিশ বক্সের ইনচার্জ সেটা না করে কীভাবে হকারদের কাছ থেকে দৈনিক টাকা তোলা যায়– সেই দিকে বেশি মনোযোগী থাকেন।
তিনি বলেন, একজন ইনচার্জই ঘুরেফিরে সেখানে দীর্ঘ ১০ বছর ধরে রয়েছেন। মাঝে একবার বদলি করা হলেও দিন দশেক তদবির করে আবার সেখানে বদলি হয়ে আসেন। গুলিস্তান-পল্টন এলাকার ফুটপাত-রাস্তার অবৈধ হকারদের ওপর এই চাঁদাবাজির বিষয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে লিখিত দিয়েছিলাম ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সেই আবেদনে পুলিশের ডিসিকে ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলেছিলেন। কিন্তু কাজ হয়নি।
তিনি আরও বলেন, পুলিশ যদি মনে করে রাস্তায় কোনো হকার থাকবে না, এক ঘণ্টার মধ্যেই তারা করতে পারে। অতীতে পুলিশই এ নজির একবার দেখিয়েছিল। পুলিশ হকারদের সঙ্গে যোগশাজস করে চললে রাস্তা দখলমুক্ত হবে না।
অভিযোগের বিষয়ে সার্জেন্ট আহাদ পুলিশ বক্সের ইনচার্জ ওবায়দুর রহমানের সঙ্গে কথা বলতে পুলিশ বক্সে গিয়ে তাঁকে পাওয়া যায়নি। ফোনে একাধিকবার কল দিলেও তিনি ফোন ধরেননি।
হকার উচ্ছেদে নেই কোন তৎপরতা !
জানা গেছে, যাত্রাবাড়ী, সায়েদাবাদ, গুলিস্তান, মতিঝিলসহ আশপাশের এলাকা হকারমুক্ত করতে পানি কম ঘোলা হয়নি। ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) সাবেক মেয়র সাঈদ খোকনের আমলে ২৮৬ দিন হকার উচ্ছেদ অভিযান চালানো হয় ওই এলাকায়। এক পর্যায়ে হকাররাই নগর ভবন আক্রমণ করে বসে। ওই আক্রমণে কিছু আওয়ামী লীগ নেতা ও পুলিশ কর্মকর্তার ইন্ধন ছিল বলে অভিযোগ ওঠে। তখন ডিএসসিসির উদ্যোগে গুলিস্তান এলাকায় আড়াই হাজার প্রকৃত হকারের তালিকা করা হয়। বলা হয়, তাদের কাউকে চাকরির ব্যবস্থা, প্রশিক্ষণ দিয়ে বিদেশে পাঠানো, নতুন মার্কেটে দোকান বরাদ্দ ও সহজ শর্তে ব্যাংকঋণ দিয়ে পুনর্বাসন করা হবে। তবে ওইসবের কিছুই করা হয়নি। বরং এর পর হকার উচ্ছেদে পিছু হটেন সাঈদ খোকন।
পরবর্তী সময়ে ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপস দায়িত্ব নেওয়ার পর গুলিস্তান ও আশপাশের এলাকার রাস্তাগুলোতে লাল, হলুদ ও সবুজ মার্কিং করে দেওয়া হয়। লাল চিহ্নিত সড়কে কখনোই হকার বসতে পারবে না। হলুদ চিহ্নিত এলাকায় সন্ধ্যা ৬টার পর বসতে পারবে। আর সবুজ চিহ্নিত পয়েন্টে সব সময় বসতে পারবে। কিন্তু হকাররা কোনো সময় তা অনুসরণ করেনি। কিছু দিন এই নিয়ম মানতে অভিযানও চালানো হয়। তারপর সেই অভিযানও থেমে যায়। এতে পুরো গুলিস্তান এলাকা অবৈধ দোকানপাট ও হকারে অবরুদ্ধ হয়ে পড়ে।
গুলিস্তান-নারায়ণগঞ্জগামী শীতল পরিবহনের চালক আবু হোসেন বলেন, ঢাকা থেকে নারায়ণগঞ্জ ২০ কিলোমিটারও না। অথচ কখনও কখনও তিন ঘণ্টারও বেশি সময় লেগে যায়। তাহলে ফ্লাইওভার করে লাভটা কী হলো?
অবৈধ হকারদের মুরব্বি প্রভাবশালীরা মোটা অংকের চাঁদার বিনিময়ে হকারদের ছাতা হিসেবে কাজ করেন তারা !
রাজধানীর হকারদের নামে রয়েছে সাতটি অবৈধ সংগঠন। এসব সংগঠনের নেতা হকারদের কাছ থেকে লাইনম্যানের মাধ্যমে চাঁদা তোলেন। বিনিময়ে হকারদের ছাতা হিসেবে কাজ করেন তারা। হকারদের কাছ থেকে নেওয়া অর্থ রাজনৈতিক নেতা, প্রভাবশালী, জনপ্রতিনিধি ও পুলিশ প্রশাসনের কিছু কর্মকর্তা ভাগবাটোয়ারা করে নেন। আওয়ামী লীগ, বিএনপি, বামসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতা এসব সংগঠনের নেতা। তারা পুলিশের সঙ্গে যোগসাজশে হকারদের কাছ থেকে নেওয়া অর্থ প্রতিদিন ভাগবাটোয়ারা করেন। এসব নেতার পেছনে আরও প্রভাবশালী নেতাও রয়েছেন বলে অভিযোগ আছে।
তবে অবৈধ সংগঠনগুলোর একটি বাংলাদেশ ছিন্নমূল হকার্স সমিতির সভাপতি কামাল ছিদ্দিকী বলেন, হকারদের নামে কেউ চাঁদাবাজি করে না। লাইনম্যানদের মাধ্যমে চাঁদা নেয় পুলিশ। পুলিশই রাস্তার মধ্যে হকার বসিয়ে চাঁদা তোলে। সেই টাকা কিছু ক্লাবকেও দেয়। সরকার চাঁদা নেওয়া বন্ধের নির্দেশ দিলে হকাররা পুলিশকে চাঁদা দেওয়া বন্ধ করে দেবে। এতে রাস্তা পরিষ্কার হয়ে যাবে, যানবাহন চলাচলও সহজ হবে।